এডিটা

সোনালী চুলের এডিটার বাড়ি পোল্যান্ডের অখ্যাত শহরে । উন্নত জীবনের আশায় আরো অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ানদের মতো সেও বছর পাঁচেক আগে স্বামী সন্তান সহ ব্রিটেনে আসে। বছর কয়েক পার্টটাইম কাজ করে টাকা জমিয়েছে। স্বামী কম্পিউটারের কাজ জানে । নিজের ব্যবসা ছিল কিন্তু পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয় দেখে ব্রিটেনে চলে এসেছে। এডিটার লক্ষ্য হল এদেশে একটা মাস্টার্স করা ,মাস্টার্স করতে পারলে বেশ ভাল চাকুরী পাবে। বেশ কয়েকবছর ধরেই বিলেতে এশিয়ান আর আফ্রিকানদের মাইগ্রেশন কমে গেছে ব্রিটিশ পলিসির কারণে। দক্ষ জনশক্তি বলতে এখন ইউরোপই ভরসা বিলেতের, কারণ এরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য বলে ফ্রি মুভমেন্ট করতে পারে এখনো । এটা নিয়েও অবশ্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা প্রতিদিন ঘেউ ঘেউ করছেন ।
এডিটা বেশ হাসিখুশি চরিত্রের । পড়ালেখায় বেশ সিরিয়াস । এই বয়েসে এতো পড়ার জোশ দেখে অবাক হয়ে যাই । একদিন জিজ্ঞেস করলাম “এডিটা কেমনে পার এতো পড়তে?”
“আরে কি যে বলো পড়ার টাইম কোথায় আমার, রাতে একটু বসি বই নিয়ে এই যা । আমি তো কিছুই পারিনা”
একদিন নিজ থেকেই বলল “তারিক তোমার খাতাটা একটু দিও”
“নিশ্চয়ই”
“তো আজ কি সারাদিন তুমুল পড়ালেখা হবে?” হাসি দিয়ে
“নারে ভাই, ক্লাস শেষে কাজে যেতে হবে, তারপর বাসায় গিয়ে রান্না করব, তারপর রাতে পড়তে বসব”
“ওরে বাবা, অনেক কাজ কাম দেখি তোমার”
সে হাসে, সেই হাসি তৃপ্তির নয় বোঝাই যায় ।
তার হাসির আড়ালেও যে কষ্টের ঘন কালো মেঘের অস্তিত্ব রয়েছে তা সহজেই অনুমেয় ।
“কি মন খারাপ কেন আজকে? কালকে পড়তে পার নাই বুঝি?” হাসি দিয়ে
“নাহ, আজ মনটা একটু খারাপ”
“কেন কি হয়েছে,জামাইয়ের সাথে লাগছে নাকি?”
“নাহ, তার সাথে লাগি না”
“তোমার থেকে যদি বাংগালী মেয়েরা কিছু শিখতো”
“শোন আমার জামাইরে বলে দিছি,আমারে ভাল না লাগলে ছেড়ে দিবা বা অন্য কাউরে ভালো লাগলেও সরাসরি বলবা”
“ওওও, তো সে কি বলছে এটা বলার পর?”
“না বলছে অন্য কারো প্রতি সে তাকায় ও না”
দুজনেই হাসি ।
তা কি নিয়ে তোমাদের লাগে ।
“আমাদের চুক্তি হল ৩ দিন সে রানবে,৩ দিন আমি । এর বাইরে গেলে আমি কিন্তু তারিক আর সহ্য
করতে পারিনা,আমি কিন্তু একটু ডমিনেটিং”
“হুম,গ্রেট । ডমিনেটিং না হলে ছেলেপেলে মাথায় চড়ে বসবে, টাইট দিবা মাঝে মাঝে” মনে মনে বলতেছি হে পরওয়ার দিগার !
“তা তোমার মন খারাপের কারণ কি আজকে?”
“জানো, আমার বয়েস যখন ১০ বছর আর আমার বোন লিলিয়ানার ১ বছর তখন আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়”
“তারপর?”
“জানোই তো পোল্যান্ড এমন কোন সমৃদ্ধ দেশ না । কত কষ্ট হয়েছে আমাদের । মা প্রতিদিন ড্রিঙ্কস করতো, ড্রাঙ্ক হয়ে বাসায় ফিরত । বোনটাকে আমি দেখতাম, এরপর আমিও স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ শুরু করি । আমাদের কত কষ্টের দিন ছিল তুমি ভাবতেও পারবানা”
“এখন তো ঠিক আছে সব?”
“জানো তারিক সেই কষ্টের দিন গুলি মনে হলে এখনো মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে । আজ কফির দোকানের মেয়েটাকে দেখে আমার সেই শৈশবের কথা মনে পড়ছিল”
“ওহ তাহলে এই হল মন খারাপের কারণ”

T11

“তোমরা হয়ত ভাবো ইউরোপিয়ান সমাজ আমাদের,এটা আর এমন কি! কিন্তু না তারিক আমাদেরও পরিবার নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে যেখানে বাবা মা থাকবে,উইকেন্ডে সবাই একসাথে ডিনার করবো । কিন্তু এতটা ঘাতপ্রতিঘাত নিয়ে বড় হই আমরা যে আমাদের সেই আবেগ আর থাকেনা”
“তো তুমি সেই ১৪ বছর থেকে কাজ করো?”
“হ্যা । মার টাকা দেয়ার ক্ষমতা ছিলোনা, কফির দোকানে কাজ করে আমি আমার নিজে খরচ যোগাতাম আর বোনের জন্যও খরচ করতাম”
“এই ডিগ্রীটা শেষ করতে পারলে তারিক আশা করি আমার জীবনের কষ্টের দিনগুলি অতীত হবে, চাকুরীর অফার আছে ভালো”
“ভালো চাকুরী পেলে মাঝে মধ্যে দাওয়াত দিও, ইউরোপ বেড়াতে আসলে তোমার বাসায় খেয়ে আসবো”
“নিশ্চয়ই”
“তোমার ছেলের কি খবর?”
“জানোনা কালকে তাকে বলছি বাবা তোমার ১৮ বছর হলে কিন্তু তুমি আলাদা বাসায় থাকবা”
“কেন?”
“দেখো এটাই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা”
“এক বাসায় থাকলে গেঞ্জাম হবে,আমারো প্রাইভেসি দরকার । বাসাটা তো বলেছি তোমাকে খুবই ছোট. দেখোনা ছোট বাসা বলে তোমাদের জন্য একদিন বাসায় পার্টিও দিতে পারছিনা ”
“বলো কি, তাই বলে ছেলেকে এভাবে বাইরে পাঠায় দিবা?”
“শোনো আমি তার যত সাপোর্ট লাগে দিব কিন্তু তাকে আলাদা বাসায় চলে যেতে হবে । নইলে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবেনা, জীবনের সংগ্রামের জন্য প্রস্তূত হতে পারবেনা”
“ও”
“চলো তারিক দুইটা কার্ড কিনবো একটু চয়েস করে দিও”
“কেন কাকে দিবা?”
“না আগের চাকুরীটা ছেড়ে দিব আজকে, নতুন জব পাইছি । আগের কলিগদের কার্ড দিতে হবে । অনেক সাপোর্ট দিছে আমার আগের বস”
“গ্রেট,খাওয়াবানা আমারে নতুন চাকুরী পাইছ?”
“পরীক্ষা শেষ হইলে পার্টি দিবো তুমি আর রিকের দাওয়াত থাকল”
ইউরোপিয়ানরা প্রায় সবাই আত্মনির্ভরশীল । এরা অনেকেই বিয়ে করেনা কারণ কখন মনোমালিন্য হয় আর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এই ভয়ে, বরঞ্চ বিয়ে না করে অনেকবছর ধরে এক ছাদের নিচে আছে এমনটাই বেশি দেখা যায় । ইউরোপিয়ান সমাজে ডিভোর্সের হার অত্যন্ত বেশী । এই ক্ষত, যন্ত্রণা তাদেরকে আবেগহীন করে গড়ে তোলে ।
T111

নিজের অজান্তেই তারা মেশিনের মতো হয়ে যায়, হয়ে যায় আত্মকেন্দ্রিক ।জীবন সংগ্রামের ভেলায় ভাসতে ভাসতে কেওবা চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আর বাদ বাকিরা পড়ালেখার পাট চুকিয়ে নেমে পরে রোজগারে । ইউরোপিয়ানদের সরকার উচ্চ শিক্ষার জন্য লোন দেয় বিনা সুদে । যতক্ষণ পর্যন্ত সে চাকুরী পাবেনা আর বেতন একটা নির্দিষ্ট অংকে না পৌঁছাবে ততক্ষণ এই লোন তাকে শোধ দিতে হবেনা । জীবনকে উপভোগ করার সমস্ত উপাদানই আছে এদেশে তবুও কেন যেন এদের কারো চেহারায় সুখ, তৃপ্তির ছাপ দেখিনা । সবাই ছুটে চলেছে অবিরত । কফির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ভাবি বাপের হোটেলে এইতো সেদিনও খেলাম,কত সুখ আংগো দেশে !!

তারিক শিমুল
কভেন্ট্রি,যুক্তরাজ্য
12.04.2017

প্রকাশক সম্পাদক : জাহাঙ্গীর কবির লিটন
এলাহী মার্কেট , ২য় তলা, বড় মসজিদ গলি, ট্রাংক রোড,ফেনী।
jagofeni24@gmail.com
© 2016 allrights reserved to JagoFeni24.Com | Desing & Development BY PopularITLtd.Com, Server Manneged BY PopularServer.Com