বিএনপি খালেদা জিয়ার আসনে নির্বাচন করবে কেনো?

মাত্র দু’মাস আগের ঘটনা। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর বিএনপি রাজধানীতে একটি মহাসমাবেশ করে। চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ‍সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি এই মহাসমাবেশ করে। এই মহাসমাবেশের মঞ্চে একটা বিশেষ নতুনত্ব দেখা যায়। সেটা হলো প্রধান অতিথি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সম্মানে চেয়ার খালি রাখা হয়। ৪৮ ফুট বাই ২৪ ফুট মাপের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মঞ্চের ব্যানারে প্রধান অতিথি হিসেবে লেখা হয় খালেদা জিয়ার নাম। এই অভিনব সম্মান প্রদর্শন বাংলাদেশে এই প্রথম। এই নতুন নাটক তৈরীর কারণ হিসেবে বলা হয়, “আমাদের নেত্রীকে সম্মান দেখানোর জন্য, তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন, নেতাকর্মীদের হৃদয়েই আছেন- সেটা বোঝাতেই আমরা প্রধান অতিথি হিসেবে তার নাম রেখেছি।” উল্লে্খ্য খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির সব বৈঠকে তার সম্মানে ‘চেয়ার খালি রাখা হয়’ বলে জানা গেছে। বিএনপির এই সম্মান প্রদর্শন বাংলাদেশে নতুন হলেও হিন্দু ধর্মের ‘রামায়ন’ পাঠে এমন একটি ঘটনা ইতিহাস থেকে জানা যায়। পাঠকদের সেই ইতিহাস অতীব সংক্ষেপে একটু বর্ণনা করতে হয়।

অযোধ্যা রাজ্যের রাজা দশরথের তিন স্ত্রী যথা কৌশল্যা, কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা। কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্ন নামে দুই যমজ পুত্রের জন্ম হয়। । তারা চার রাজকুমার অস্ত্রবিদ্যা ও শাস্ত্রবিদ্যা- উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তবে ধনু বিদ্যায় রাম বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। মিথিলার রাজা জনকের কন্যা ছিলেন অপরূপা সীতা। অবশ্য তিনি সীতাকে জমিতে লাঙ্গল চালানোর সময় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। যাক, সীতার বিয়ে উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত স্বময়ম্বর সভায় রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে উপস্থিত হন ঋষি বিশ্বামিত্র। রাজা জনককে শিব একটা ধনুক উপহার দিয়েছিলো। রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে ব্যক্তি এই ধনুকে গুণ টানতে পারবে, তার সাথেই বিয়ে হবে অপরূপা সীতার। কেবলমাত্র রামই সেই ধনুকে গুণ পরাতে সক্ষম হয়। প্রতিজ্ঞ অনুযায়ী মহাসমারোহে রামের সঙ্গে সীতার বিয়ে হয় । মূলত বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হলেন ভগবান রাম।

রাম-সীতার বিয়ের বারো বছর পর রামকে যৌবরাজ্যের দায়িত্ব অর্পনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন বৃদ্ধ রাজা দশরথ। কিন্তু রাণী কৈকেয়ী দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণায় রাজার পরিকল্পনা নষ্ট করেন। রাণী হঠাৎ দাবী বা আবদার তোলেন রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে এবং তার পরিবর্তে ভরতকে রাজ্যের ভার অর্পন করতে হবে। ভরত কৈকেয়ীর পুত্র। অতীতে কৈকেয়ীকে দুটি বর দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন রাজা দশরথ। এই সুযোগ কাজে লাগালেন কৈকেয়ী। প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য কৈকেয়ীর কথা মেনে নেন রাজা এবং পিতার আদেশ মেনে নেয় রাম। স্ত্রী সীতা আর ভাই লক্ষ্মণকে সাথে নিয়ে নির্বাসনে দণ্ডকারণ্যের বনবাসে যায় সে। রামের বনে যাওয়ার কিছুদিন পর তাঁর পিতা পুত্র শোকে মৃত্যুবরণ করেন। রামের বনবাসের সময় । দশরথের দ্বিতীয়পুত্র ভরত ও শত্রুঘ্ন ছিলেন মামার বাড়ি নন্দীগ্রামে। ভরত পিতার মৃত্যুসংবাদ শুনে অযোধ্যায় ফিরে আসে। রাম বনবাসে যাওয়ার পিছে মন্থরা এবং তার মায়ের কুটিল চক্রান্তের কথা জানতে পারে। ভাইদের মধ্যে প্রচন্ড ভালোবাসা থাকায় ভরত সেই রাজপদ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশ্য ভরত মন্থরাকে অভিশাপ দেন যাতে তিনি কোনোদিনই স্বর্গে জায়গা না পান। ভরত প্রচন্ড দুঃখে রামকে খুঁজতে খুঁজতে দণ্ডকারণ্যে বনে উপস্থিত হয়। তিনি বড়ভাই রামকে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার জন্য ভরত অনুরোধ করেন। কিন্তু রাম পিতার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে রাজি হয় না। চৌদ্দ বছর শেষ না হলে অযোধ্যায় ফিরে যাবেন না বলে ভরতকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তখন ভরত রামের প্রতীক স্বরূপ তাঁর রামের খড়ম দু’টি চেয়ে নিয়ে সঙ্গে আসে। রাজ্যে ফিরে সেই খড়ম দুটিই সিংহাসনে স্থাপন করে ভরত নন্দীগ্রামে থেকে রামের নামে রাজ্যশাসন করেন। মূলত রাজ্যের সব আরাম-আয়েশ তিনি ও তার স্ত্রী মাগুবী ত্যাগ করেন। এক ফুট মাটি খুঁড়ে ঘুমোতেন ভরত। স্বামীকে সম্মান জানাতে দু’ফুট মাটি খোঁড়েন মাণ্ডবী। প্রাসাদে ছিলেন একমাত্র শত্রুঘ্ন। বলা যায়, শত্রুঘ্ন আর শ্রুতকীর্তিই এই ১৪ বছর রাজ কার্য পরিচালনা করেন।

রাম-সীতার পুরো গল্প বলা এখানে উদ্দেশ্য বা বিষয় নয়, শুধু রামের অনুপস্থিতিতে কীভাবে ভাইয়ের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে ভরত সিংহাসনে রামের পাদুকা রেখে দিয়ে রাজ্য চালিয়েছেন সেই অংশ তুলে ধরা। আজকে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সমাবেশে কিংবা বৈঠকে তার জন্য চেয়ার খালি রাখেন সম্মানার্থে, এটা ‘ভরত’ থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন বলা যায়। এইভাবে সম্মান জানানো অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়। এটাকে যদি সাধুবাদ দিই তাহলে বলতে চাই বিএনপি কেনো ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে? খালেদা জিয়ার প্রতি সম্মানের নিদর্শন হিসেবে তো একটা আসন কম থাকার কথা। বিশেষত বেগম খালেদা জিয়ার আসনটা তো তার সম্মানার্থে ছেড়ে দেয়ার কথা। সেই হিসেবে বিএনপি ২৯৯ আসনে নির্বাচন করার কথা। কিন্তু দেখা গেলো নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়ার আসনে অসংখ্য নেতা মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত ফেনী-১ আসনে মোট ১৩জন প্রার্থী হয়েছেন। কী হাস্যকর! যেখানে নেত্রীর প্রতি ভালোবাসায় গদগদ হয়ে চেয়ার ফাঁকা রাখা হয় সেখানে নেত্রীর আসনে ১৩জন নেত্রীর চেয়ার নিয়ে টানাটানি করেন। এটাকে কী বলবো? ভন্ডামী? ব্যাপারটা এই হওয়ার কথা ছিলো যে, বেগম খালেদা জিয়ার আসনে বিএনপি স্বেচ্ছায় নির্বাচন বর্জন করেছে। যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁর সমকক্ষ ব্যক্তি কেউ হবে না। সেটাই হতো খালেদা জিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।

arzufeni86@gmail

লেখকঃ কলামিস্ট, আবৃত্তিকার ও নজরুল গবেষক।

প্রকাশক সম্পাদক : জাহাঙ্গীর কবির লিটন
এলাহী মার্কেট , ২য় তলা, বড় মসজিদ গলি, ট্রাংক রোড,ফেনী।
jagofeni24@gmail.com
© 2016 allrights reserved to JagoFeni24.Com | Desing & Development BY PopularITLtd.Com, Server Manneged BY PopularServer.Com