এমপি হবেন হিরো আলমদের মতো মানের নেতারা

দেশে গত এক দশকে মূল্যবোধের এতো চরম উন্নতি হয়েছে যে, চারদিকে কেবল চোর আর চোর। যেনো বাংলাদেশে চোরের গোডাউন আছে। তর্ক না করে সারাদেশে কারাগারগুলোতে কী পরিমান অপরাধী আছে তার হিসাব নিলেই সত্যতা পাওয়া যাবে। আমাদের দেশে আজ নৈতিকতার কত উন্নতি হয়েছে তার নমুনা পাওয়া যাবে দেশের সুশিক্ষিত ভদ্রজনদের চুরির ঘটনা শুনলে। দেশের একজন গুনিজন নামে পরিচিত ‘ডাক্তার জাফর উল্লাহ’র বিরুদ্ধে মাছ চুরি গাছের্ ফল ছুরির মামলা হয়েছে। তিনি চুরি না করলেতো আর মামলা হয়নি! বলুন, তাহলে এদেশ যে চোরদের রাজ্যে পরিণত হচ্ছে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? কী ভয়াবহ কথা! এই প্রজন্ম এমন যে, কোনো কিছু পরিশ্রম করে অর্জন করতে চায় না। তারা চায় সর্টকার্ট রাতারাতি উচ্চশিখরে পৌঁছতে। সব কিছু অবৈধ পথে পেতে। কারণ তাদের চারপাশে যা দেখে সব অবৈধ সব চুরি করে পাওয়া। চুরি অবৈধ আর সর্টকার্ট পদ্ধতিতে যেটা পাওয়া যায় তার পেছনে সবাই ছোটে। এ প্রজন্ম দেখেছে যারা জনপ্রতিনিধি তারা জনগনের ভোটের চাইতে ভোট চুরি করে কিভাবে পাশ করা যায় সেই রাস্তা খোঁজে। কোনো সাধনা ছাড়াই রাতারাতি মিডিয়ায় ঢুকে জনপ্রিয় হতে চায়। ফলে যত প্রকার অনিয়ম আছে সব করতে রাজি।
প্রতিটা ক্ষেত্রে জীবনমান কোথায় নেমে গেছে তা বুঝতে গত এক দশকে জাতীয় সংসদে যারা প্রবেশ করেছে তাদের দিকে তাকালেই জানা যাবে। আমরা একসময় দেখেছি জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে প্রার্থী হওয়ার জন্য পড়ালেখা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, রাজনীতিতে বিশেষ অবদান এবং জনগণের সাথে যাদের উঠাবসা, জনগণকে বিপদে-আপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা ইত্যাদি যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হতো। আর গত একদশক যাবত দেখছি যাদের সংসদ সদস্য হিসেবে দলের পক্ষ থেকে টিকেট দেয়া হচ্ছে- তারা বাজারের নর্তকী-গানওয়ালা-যাত্রাপালার শিল্পী কখনো বিশেষ ক্ষেত্রে সিনেমার নায়িকা-গায়িকা এসব। তাদের বড়জোর সামাজিক নাম প্রচারের কারণে খ্যাতি রয়েছে। তাদের ব্যক্তি চরিত্র বলতে কিছুই নেই। জনগণের সাথে সম্পর্ক নেই, রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। কেউ তিন চারজন স্বামীর সংসার করা, কেউ তিনচারটা বউসহ কয়েক ডজন কলগারল নিয়ে জীবনযাপন করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, গত এক দশক এদের থেকে সংসদ সদস্য হয়েছে। বর্তমান অবস্থা আরোও খারাপ। যার নমুনা- চানাচুর বিক্রেতা এমপি প্রার্থী ‘হিরো আলম’।
আমাদের সামনে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ’ নির্বাচন আগামী ৩০শে ডিসেম্বর। এবারে নির্বাচনে সারাদেশের ৩০০ আসনের বিপরীতে ৩০৫৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে, যদিও ১২০২৩টি মনোনয়নপত্র কেনা হয়। তাদের মধ্যে নোমিনেশন ক্রয় করেছেন সারাদেশে আলোচিত সমালোচিত ভাইরাল ‘হিরো আলম’। তিনি গত ১২ নভেম্বর বগুড়া-৪ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ফলে হিরো আলমকে নিয়ে সর্বত্র আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এমপি প্রার্থী হওয়ার আগেই তিনি অনেক বিখ্যাত। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সেরা ভাইরাল হিসেবে হিরো আলমকে তুলে ধরা হয়েছে। ইন্টারনেটে সার্চের ক্ষেত্রে বলিউড তারকা, সালমান খানকেও ছাড়িয়ে গেছেন হিরো আলম। একজন চানাচুরওয়ালা ‘হিরো আলম’ কিভাবে এমপি হওয়ার জন্য লড়তে চাইছেন তার সম্পর্কে জনমনে কৌতুহল থাকবে সবাই জানতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা সেই ‘হিরো আলম’ সম্পর্কে কিছু জানবো।
বগুড়া জেলার এরুলিয়া গ্রামের সন্তান আশরাফুল আলম। এক ভাই এবং তিন বোন। বর্তমান বয়স ৩২বছর । তার উচ্চতা পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি। ঠিকমতো উচ্চারণে কথা বলতে পারেন না। গাযের রং কালো, চেহারার কোনো সৌন্দর্য নেই। তার নিজ পিতার মৃত্যুর পর তার মাকে বিয়ে করেন আবদুর রাজ্জাক। পালক পিতা আবদুর রাজ্জাকের কাছে হিরো পালিত হন। অভাবের মধ্যেই পালক পিতার ঘরে বড় হন। পালক পিতা তাকে গ্রামের স্কুলে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করান। জীবিকা নির্বাহের জন্য চানাচুর বিক্রি শুরু করেন। এরপর শুরু করেন সিডি বিক্রি ব্যবসা। তখন লোকে তাকে ‘সিডি আলম’ বলে ডাকতো। এরপর শুরু করেন ক্যাবল নেটওয়ার্ক ডিশ ব্যবসা। তখন থেকে লোকে তাকে ‘ডিশ আলম’ নামে ডাকে। ২০০৯ সালে পাশের গ্রামের সুমী নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন হিরো আলম। তার স্ত্রী এসএসসি পাশ। তার তিন সন্তান। তিনি নিজ গ্রামে দুইবার মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করে হেরে যান সামান্য ভোটে। তাতে তিনি মোটামুটি পরিচিতি কিংবা জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সিড়ি বিক্রির সময় সিনেমার নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সাহস করে ২০০৮ সালে একটা মিউজিক ভিডিও তৈরী করেন ফেলেন এবং সেই ভিডিও নিজ ক্যাবল লাইনে প্রচার করতে থাকেন। সস্তা মিউজিক ভিডিও তিনি নিজের উদ্যোগেই নির্মাণ ও প্রচার করে থাকেন। মূলত ভাঁড়ামির জন্যই এসব মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে তিনি পরিচিতি পান। মিউজিক ভিডিওতে নিজেকে হিরো চরিত্রে উপস্থান করে তিনি নিজেকে হিরো দাবী করেন। ফলে আশরাফুল হোসেন আলম বা ডিস আলমের পরিবর্তে তিনি নিজের নামের আগে ‘হিরো’ বসিয়ে ‘হিরো আলম’ হয়ে যান। ইউটিউবে তার ভিউয়ারের সংখ্যা-এক কোটি দশ লাখ, আর সাসক্রাইবারের সংখ্যা-সাতাশি হাজারেরও বেশী। ফেসবুকেও তিনি ‘হিরো আলম’ নামে আইডি খুলেন।
বর্তমানে তিনি নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি বলে দাবী করেন। কথাটা নেহায়েত ভুল নয়। কারণ তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর দেশের মূল ধারার গণমাধ্যম তাকে নিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। আগে তাকে যদি বগুড়ার মানুষজন চিনতো কিংবা তরুনদের কিছু অংশ পেসবুক কিংবা ইউটিউবে চিনতো, এখন তাকে দেশের সকল স্তরের মানুষ চিনে-জানে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তার লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচার করে। তাকে টকশোতে নিয়ে আসে। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে দর্শক তৈরী করে। ফলে এখন আর হিরো আলমকে অচ্যুত অশুচি বা অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। জাতীয় গণমাধ্যমে হিরো আলম তার জায়গা করে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে তিনি অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আমার বাবার অবস্থা ভালো ছিলো না। যারা আমার সমালোচনা করে, তাদের পিছে যদি তাদের বাবা না থাকতো তাহলে তাদেরও আমার মতো অবস্থা হতো। আমিতো হিরো আলম হয়েছি-তারা গার্মেন্সে চাকরী করে খাওয়া লাগবে, সিএনজি রিকসা চালিয়ে খাওয়া লাগবে। আমারে কেউ হিরো বানায় নাই। আমি নিজের চেষ্টায় নিজেরে নিজেকে ‘হিরো’ বানাইসি। শুধু উপরওয়ালা সঙ্গে ছিল। আজকে আমাকে দেখে স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা উৎসাহিত হচ্ছে। লোকে সাধনা করে, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওনের জন্য। আমি চেষ্টা করসিলাম হিরো হবো। আমি যদি এমপি হই, তা হলে মানুষের সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে কাজ করে যাব। কোন মন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেলে আমি সাত দিনেই দেশ ঠিক করে ছাড়বো।”
গত ১০বছরে বাংলাদেশের যে কী উন্নয়ন হয়েছে তা হিরো আলম এমপি প্রার্থীর হওয়ার মধ্য দিয়ে মাপা যায়। যদিও শেষপর্যন্ত তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। তরুনদের আইডল এখন ‘হিরো আলম’। এখনকার তরুন প্রজন্ম হিরো আলমের ‘মার ছক্কা’ ছবির ডায়লগ বলে,“নাম আমার হিরো আলম, জালিমদেরকে লাগাই মলম। মারব বগুড়ায়, লাশ পড়বে মাগুড়ায়।” হিরো আলমদের চাইতে বেটার কোয়ালিটির এমপি এযুগে আশা করা বোকামী। এখন খালেদা জিয়ারা রাজনীতির জন্য অযোগ্য। আগামী দিনে এমন কোয়ালিটিফুল নেতাইতো দেশের মন্ত্রী হবে। আমাদের দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য হিরো আলমদের, ইয়াবা সম্রাটদের, ভূমি দস্যুদের, দুনীর্তিবাজদের, সন্ত্রাসের গড় ফাদারদের, চরিত্রহীনদের সংসদে আসা একান্ত জরুরী। তেঁতুল গাছ থেকে তো আর আঙ্গুর ফল হবে না! চায়ের কাপে পিঁপড়া দেখে ওয়েটারকে ডেকে লোকটা জিজ্ঞেস করে, এই দেখ চায়ে পিঁপড়া ভাসছে। ওয়েটার বললো, স্যার- ৫টাকার চায়ে পিঁপড়া ভাসবো নাতো কি জাহাজ ভাসবো? arzufeni86@gmail
লেখকঃ কলামিস্ট, আবৃত্তিকার ও নজরুল গবেষক।

 

 

 

প্রকাশক সম্পাদক : জাহাঙ্গীর কবির লিটন
এলাহী মার্কেট , ২য় তলা, বড় মসজিদ গলি, ট্রাংক রোড,ফেনী।
jagofeni24@gmail.com
© 2016 allrights reserved to JagoFeni24.Com | Desing & Development BY PopularITLtd.Com, Server Manneged BY PopularServer.Com