ডেস্ক রিপোর্ট» তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাত থেকে ২০১৮ সালে এক বিলিয়ন এবং ২০২১ সালে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ খাতে ২০২১ সালের মধ্যে ২০ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে রফতানি আয়ের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন নির্ভর করছে সরকার কতোটা আন্তরিক, তার ওপর। বেসকারি খাত লক্ষ্যপূরণে প্রস্তুত। তবে এ জন্য সরকারের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি দেশিয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক প্রণোদনা প্রদান এবং তাদের উন্নয়নে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রায় চার লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ একসময় আইটি খাতে এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এটি অকল্পনীয় বিষয় ছিল। ২০১০ সালের দিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। সম্ভাবনাময় এ খাতে কর্মসংস্থান বাড়তে থাকে ২০১১ সালের পর থেকে। ২০১৪ সালের দিকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এক লাখের ওপরে মানুষ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ প্রসঙ্গে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি রফতানি পাঁচ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ২০ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের বয়সই ৩৫ বছরের নিচে। দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তাদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে সারাদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যা তরুণদের চাকরির নির্ভরতা কমিয়ে উদ্যোগী হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।
এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয় বেড়েছে। তবে এ খাতের রফতানি আয় এখনও ২০ কোটি ডলারে পৌঁছেনি। সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার। অর্থবছরটিতে আগের বছরের তুলনায় তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয় বেড়েছে এক কোটি ৯৩ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ।
তথ্য প্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয়ের চিত্র :
তবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করছেন দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাতের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সফটওয়্যার ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি মোস্তফা জব্বার।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ৭০ কোটি ডলারের ওপরে রফতানি আয় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য দিয়েছে তা সঠিক নয়। ব্যাংকিং মাধ্যমে টাকা আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। যে কারণে অনেকেই ভিন্ন উপয়ে টাকা আনেন। এছাড়া ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে সফটওয়্যার ও সেবাখাতের আয়ের রিপোর্ট করে না।
এদিকে, বেসিস’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবের বাইরে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)-তে গত বছর প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এছাড়া ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের সঠিক হিসাব না থাকলেও তাদের আয় কম-বেশি ১০ কোটি ডলার। অর্থাৎ বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেইমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আইটি সেক্টর, ফ্রিল্যান্সিং- সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে প্রায় ৪০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে।
এতে বলা হয়েছে, ব্যক্তিপর্যায়ে প্রযুক্তি সেবায় বিপুল পরিমাণ আয় হলেও তা ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আসছে না। বেসিস সদস্যভুক্ত আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে ৯৫৬টি। ৩৮২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তারা গত বছর ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রফতানি করেছে। এ হিসাবে ৯৫৬টি সদস্য প্রতষ্ঠিানের রফতানি আয় আনুমানিক ১৪৮ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার।
বেসিস সদস্যভুক্ত নয় এমন আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা রয়েছে অন্তত এক হাজার। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর রফতানি আয় আনুমানিক ১৫৫ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুমানিক রফতানি আয় ৩০৪ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার।
বেসিস বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে মধ্যপ্রাচ্য, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং জাপান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে আইটি ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। কারণ দেশগুলো সফটওয়্যার ও আইটি আমদানি করে থাকে।
মোস্তফা জব্বার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে যে রফতানি আয়ের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তা বাস্তবায়নে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই জরুরি। আমরা হাইটেক পার্ক জাতীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাপক তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যে সড়ক দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রবাহিত হবে তার অবস্থা নাজুক। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেটের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। সরকার ক্যাবল সংযোগ সম্প্রসারণের চেষ্টা করলেও বেতার সংযোগ এবং এর গতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। ইন্টারনেটের দামও সহনীয় নয়। ইন্টারনেট সংযোগ আরও সুলভ হওয়া উচিত। ঢাকার বাইরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রয়োজন। এছাড়া নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য সুলভে জায়গা বরাদ্দ দেয়া দরকার।
তার মতে, দেশিয় আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠন করা আবশ্যক। বেসিস থেকে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল বরাদ্দের আবেদন জানানো হয়েছিল যা এখনও স্থবির আছে। ইইএফেরও (সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল) একই অবস্থা। মেধাসম্পত্তি মূল্যের সঠিক নির্ধারক না থাকায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একমাত্র আইডিএলসি ছাড়া আর কেউ আইটি কোম্পানিকে ঋণ দেয় না। আইডিএলসি’র বরাদ্দ মাত্র ৪৩ কোটি টাকা যা আইটি কোম্পানিগুলোর রফতানির সক্ষমতা তৈরিতে পর্যাপ্ত নয়।
মেধাসম্পত্তির কপিরাইট, মূল্যের নির্ধারক ও পরিচালনার সঠিক অবকাঠামো তৈরি এখন সময়ের দাবি। সাধারণ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছাড়াও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলোর বিস্তার ঘটাতে হবে বলে মত দেন এ বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, দেশের রফতানি বাণিজ্যে আরও বেশি উৎসাহিত করতে সরকার বেশ কয়েকটি খাতে ভর্তুকি/নগদ সহায়তা প্রদান করছে। আইটি রফতানি খাতে মানুষকে উৎসাহিত করতে পৃথিবীর বহু দেশে নির্দিষ্টহারে প্রণোদনা দেয় হয়। পাঁচ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেশের এ উদীয়মান আইটি খাতেও ভর্তুকি প্রদান করা উচিত। আগামী বাজেট থেকে এ নগদ সহায়তা দিলে আইটি খাতের অগ্রযাত্রা সহজ হবে।
‘অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পোশাক শিল্পের আজ এ অবস্থানের পেছনে সরকারের অবদান ছিল। প্রাথমিক অবস্থা থেকে এ শিল্পে সরকারি বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন দশক পরও সরকার এ খাতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। আইটি খাতের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের এমন সহায়তা প্রয়োজন’- বলেন মোস্তফা জব্বার।
।। জাগো নিউজ