তারিক শিমুল» আদ্রিয়াটিক সাগরের জলে সিক্ত ছোটবড় ১১৮ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ভেনিস নগরী। রোম থেকে প্রায় ৩৫০ মাইল দূরের মাইল এই নগরীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগের দিন রাতে। প্রায় ১০৯ পাউন্ডের দখল সামলাতে পারব কিনা ভাবতে ভাবতে রাত ৮ টা। ভাবলাম না হয় লন্ডনে গিয়া দুইবেলা কম খাব তাও ভেনিস না দেখে যাওয়া ঠিক হবেনা। যেই ভাবা সেই কাজ, তবে যাওয়ার ভাড়াটা ধার করতে হয়েছিল রোম প্রবাসী চাচাতো ভাই মঞ্জুর নিকট। বুলেট ট্রেন গ্রাম, পাহাড়, মাটির নীচ দিয়ে পার হয়ে পৌনেচার ঘন্টা পর পৌছে দিল ভেনিসের ট্রেন স্টেশনে। সাড়ে বারোটার ১০মিনিট আগে পৌঁছাবে বলেছে ঠিক তাই হয়েছে। কিভাবে যে এরা সময় মেপে সব করে আমার মাঝে মাঝে মাথা ঝিম ঝিম করে। মানুষ এতটা পারফেক্ট হয় কিভাবে!
স্টেশন থেকে নেমে একটু সামনে হেটে যেতেই চোখে পড়ল সেই চিরচেনা ছবির মত পানিরউপরেরশহরটি। ট্রেন স্টেশন আর মধ্যযুগীয় বিশালাকার চার্চটি পরস্পরের বিপরীতে নদীর দুধারে।
নদীর দুপারকে একত্রিত করেছে ছোটছোট কতগুলি সেতু। তবে এই সেতুগুলো বাংলাদেশের কাল্ভার্টের মত নয় বেশ উচু আর ধনুকের মত। খাবারের খোজে এদিক ওদিক তাকাই। নাহ্ যুতসই খাবারের দোকান নেই। সব বার্গার আর কফির দোকান। বার্গারের দোকানে হালাল কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে এক দোকানী মনে হল আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর টুনা মাছের তৈরী একটি বার্গার হাতে নিয়ে নদীর ওপারে রওয়ানা দিলাম। এদিক সেদিকে তাকাই আর খুজে ফিরি বাংলাদেশী কাউকে আমি আগেই জেনেছিলাম ভেনিসে প্রচুর বাঙ্গালী থাকে।যাক শেষে পেয়েও গেলাম এক বাংলাদেশী দোকানীকে। সে বলে দিল রিয়াল্টা ব্রীজ আর সান মার্কো স্কয়ার না দেখে ভেনিস থেকে ফিরলে পস্তাতে হবে পরে।
তার কথামত আগাতে থাকি রিয়াল্টা ব্রিজের দিকে। অলিগলি পার হয়ে যেতেই থাকি ব্রীজের দিকে পথ আর শেষ হয় না। মাঝ পথে চোখে পড়ল সুন্দর মালা আর গ্লাসের তৈরী নানা শোপিসের এক দোকান।
আরো অবাক হলাম দোকানী কে দেখে। চেহারায় বাংলার দামাল ছেলের মতই মনে হল। ভাই শব্দটা উচ্চারণ করতেই জ্বী বলেন। বুঝলাম না দাও মেরে দিয়েছি আজকে। কিশোরগঞ্জের সন্তান আরিফের কাছেই প্রথম জানলাম ভেনিসের হাজার বছরের বিখ্যাত এক পণ্যের নাম হল মুরানো গ্লাস। এটা হাজার বছর ধরে তারা হাত দিয়ে বানায়। অপূর্ব সুন্দর গ্লাসের তৈরী মালা গুলি দেখে কিনার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিয়েই নিলাম একটা আরিফের বদান্যতায়। আরিফের আতিথেয়তায় আবারো ফুটে উঠল বাঙ্গালীর আতিথেয়তার ঐতিহ্য। তার পাশের দোকানি আবার ফেনীর ফুলগাজীর ছেলে। দোকানে প্রচন্ড ভীড় থাকায় তার সাথে কথা বলার ফুরসত হলোনা। আবারো এগুলাম রিয়াল্টা ব্রীজের দিকে। ব্রীজের উপর , দুধারে বিশ্ববিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকান।
এতো লোকের ভীড়ে শুধু ব্রীজটা না পুরো ভেনিসই টইটুম্বুর। সাদা রং এর বেশ চওড়া ব্রীজটা দেখে মনে হল বেশ পুরানো তবে একে রং ঢং করে আধুনিক একটা রূপ দেয়া হয়েছে,মধ্যযুগীয় ব্রীজও হতে পারে কারণ ভেনিস এর ইতিহাস বেশ পুরানো। ভেনিস রেনেসাঁ যুগের বেশ বিখ্যাত এক শহর। তখন এর নাম ছিল ভেনেসিয়া। ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে দুদিকে তাকালে চোখে পড়বে নদীতে চলাচলরত পানসীগুলো, আর দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভবন গুলো। সূর্যের তীব্র আলোতে ভেনিস সেদিন ঝকমক করছিল।
এবার আগালাম সান মার্কো স্কয়ারের দিকে। এই রিয়াল্টা ব্রীজ আর সান মার্কো স্কয়ার যেতে কম করে হলেও ১০০ টা গলি পার হতে হয় তবুও কাউকে না জিজ্ঞেস করেই আপনি যেতে পারবেন কারণ প্রতিটা বিল্ডিং এর উপরেই ডিরেকশন দেয়া আছে। আরো কিছুক্ষণ হাটার পর পেলাম সেই বিখ্যাত সান মার্কো স্কয়ারের।
অদ্ভুত সুন্দর এই সান মার্কো স্কয়ার। আমার এক ব্যাচমেট পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তার ফেসবুকের ছবির সাথে মিলে গেল সেই জায়গাটির। সাগরের পারে বিশালাকার এক চার্চ, তার মুখোমুখি দুপাশ দিয়ে গড়া লম্বা বিল্ডিং দুটোর মাঝখানে শতশত কবুতরের আনাগোনা। মনে হচ্ছিল সিলেটের হজরত শাহজালাল (রাঃ) এর দরগাহ এর মিনি ভার্সন। প্রচন্ড রোদ আর পর্যটকর ভীড়ে স্কয়ারটা মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তবে লোকজন বলছিল এখনো নাকি পর্যটকরা আসাই শুরু করেনি। মার্কো স্কয়ার একদম সাগর লাগোয়া। সাগরের দিকে আগাতে থাকি মুরানো দ্বীপে যাব বলে। প্রায় ১৪ ইউরোতে ৩৫ মিনিটের বোট জার্নিতে মুরানো দ্বীপে গিয়ে পৌছি তখন বাজে বেলা ২ টা।
ছিমছাম প্রচন্ড নিস্তব্ধ একটা দ্বীপ এই মুরানো। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোকের আহ্বানে পেছন পেছন আগাতে থাকি আমরা কয়েকজন। নদীর দ্বারেই সেই মুরানো গ্লাসের ফ্যাক্টরী। বুঝাই যায়না বাইরে থেকে এটা ফ্যাক্টরী। কোথাও নেই একটু ময়লা, নেই কলকাকলী। ফ্যাক্টরীর মালিক ভেতরে নিয়ে গেলেন আমাদের জনা দশেক অভিযাত্রীকে। লম্বা রডের মাথায় ভরে গ্লাসের দলা নিয়ে ঢুকানো হল আগুনের চেম্বারে , ২ মিনিট বাদেই নামিয়ে আনা হল প্রায় গলিত গ্লাস। তারপর একে হাতের কারুকার্যে ফুলের শেপ দেয়া হল। এই গ্লাসের বিভিন্ন মডেল যে হাতের তৈরী বলেছিল মিথ্যা মনে হলনা। মুরানো দ্বীপের এই গ্লাস শিল্প আগে মূল ভেনিস শহরেই ছিল তবে ১২৯৬ সালে আগুন লেগে এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটলে একে মূল শহর থেকে এই দ্বীপে পাঠানো হয়। সেই কারখানা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে আগাই,প্রচুর গ্লাসের দোকান নদীর ধারে। প্রতিটা দোকানেই অদ্ভুত সুন্দর রকমের নানাবিধ গ্লাসের পণ্য।
এক ফুলদানী দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, দাম দেখতেই বেলুনের মত চুপসে গেল আমার উত্তেজনা। দাম হল ৬৫০ ইউরো মানে বাংলাদেশী টাকায় ৫৫০০০ টাকা। আর দেরী করে হতাশ না হয়ে পেটের ক্ষূধা মেটানো দরকার। এক কফি বারে গিয়ে একটা কোক কিনতে চাইলাম তবে দাম শুনে এক ঝটকায় পিছনে ফিরে আগাতে থাকি। বারের মহিলার ডাকে আবারো সম্বিত ফিরে পাই। সে বলে দিল তুমি সামনে একটা সুপারশপ পাবে ওখানে যাও, কমে পাবা। ৫ মিনিট হাটার পর পাই সেই মিনি সুপারশপ। এক বোতল ফান্টা আর এক প্যাকেট স্ট্রবেরিই আমার সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ মনে হল।
এগুলি নিয়ে আবারো শান্ত , স্নিগ্ধ নদীর দ্বারে বসে গিলতে থাকি। ঘড়ির দিকে তাকাই ৩ টার উপরে বাজে। ধীরে ধীরে স্টেশনের দিকে যাওয়া দরকার। উঠে পড়ি এক পানসীতে স্ট্রবেরী আর ফান্টা নিয়ে। সামনের সীটে বসা ইতালিয়ান মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করি স্টেশন কত দূর। সে বোঝেনা ইংলিশ আবারো আস্তেআস্তে বলি এবার মনে হয় কিছুটা বুঝেছে। তাকে কয়েকবার সাধার পর একটা স্ট্রবেরি খাওয়াতে পারলাম। ইউরোপিয়ানদের একটা বিষয় দেখলাম এরা সহজে কারো কাছ থেকে কিছু নিতে চায়না। এদের মধ্যে কালেক্টিভ ফিলিংস, শেয়ারড ফিলিংস খুব কম, ছোটবেলা থেকেই এরা এভাবে বেড়ে উঠে। ভেনিসের স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে সে আকার ইংগিতে কি বুঝাল কিছুই বুঝা গেলনা। মোবাইলে কতক্ষণ টিপাটিপি করে যা বলল তাতে বুঝলাম কবরস্থানে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি
Graveyard এবার চোখে মুখে বিজয়ের হাসি, বোঝাতে পেরেছে। এই বিকেলে কেন সে কবরস্থানে যাচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করলাম না, কারণ এদের সাথে ইংলিশ বলে বোঝাতে অনেক শক্তি লাগে। শেষ বিকেলে আমার আর অত শক্তি নেই। স্টেশনে নেমে একটু হেটে ছায়াঢাকা একটা দেয়ালের উপর হেলে পড়ি। খানিক দূরে কয়েকজন বাঙ্গালী কে দেখলাম, পোশাকে মনে হল তার ভেনিসের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। ওদের কাছে গিয়ে বসি ,এগিয়ে দেই স্ট্রবেরী, ফান্টা, খেজুর আর ব্যগে থাকা চানাচুর । ওরা পরিচয় জানতে চায়, কি করি কোথায় থাকি দেশে। কথায় কথায় জানতে পারি একজনের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। তার ভিপি জমিটা অনেকদিন ধরে নামজারী হচ্ছেনা। এই প্রবাসীদের জন্য কিছু করতে পারলে আমার চিরদিনই ভাল লাগে। এই নিয়ে আমার আগের কর্মস্থলের একটা গল্প্ব আছে। ওটা আরেকদিন বলব। ভেনিসের নদীর ধাঁরে বেঞ্ছিতে বসে ফোন করি ফরিদপুর সদরের ইউএনও আমার ব্যাচমেট কে। তার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেই। তার চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ ক্লান্ত বিকেলের রুক্ষ পরিবেশকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছে। তারা এবার আমাকে কিছু খাওয়াবেই। তারা শুরু থেকেই বলছিল আমি তাদের ভেনিস এসে খাওয়াচ্ছি এটা ঠিক হচ্ছেনা, আমি যতই বলি আমি ১৬ কোটি মানুষের করের টাকায় বিলেত পড়তে এসেছি, সেই করের টাকায় খাওয়াচ্ছি তারা মানতেই চায়না। তবুও বিদায় নেই এবারের মত। খানিক দূরে একটা ক্যাফেতে গিয়ে একটা কোক গিলতে থাকি আর দূরের বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রায় সব বিল্ডিং এর বয়স কম করে হলেও ১০০ বছর, তবে অধিকাংশই মধুযুগের বিলেতি স্থাপত্য নকশায় গড়া। এতগুলো দ্বীপে ঘুরলাম কোথাও নেই এক ফোটা ধূলা। পুরো ভেনিসই পাথর বা ইটে ঢালাই করা।
তাদের হাতে যখন রেনেসাঁ যুগে অর্থ ছিল তারা তাদের দেশকে গড়ে তুলেছে আজকের উপযোগী করে। পুরো ভেনিসের চারদিকে তাকালে মিনারের চূড়ার মতন দেখতে গগনচুম্বী স্থাপনা গুলিকে দেখে ভেবছিলাম মসজিদ ছিল বুঝি এখানে। পরে জানলাম এগুলি আসলে চার্চ, কে জানে তারা অটোমানদের কাছ থেকে স্থাপত্যবিদ্যা ধার করেছিল কিনা!