ডেস্ক রিপোর্ট»মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশে উদযাপিত দুটি উৎসবের একটি ঈদুল আজহা। এ উৎসবে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পশু কোরবানির পর তা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং অসহায় লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের মুসলিম দেশগুলোতে এ ঐতিহ্যটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপিত হলেও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে এটি ততোটা গুরুত্বপূর্ণভাবে উদযাপন করা হয় না। বাংলাদেশের গরীব মানুষদের শরীরের প্রোটিনের অনেকটাই জোগান আসে ধর্মীয় এ ঐতিহ্য থেকে। বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের মূল কাঁচামাল চামড়ার বেশিরভাগেরই জোগান আসে এ সময়। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যমান প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
আগে লোকজন তাদের বাড়ির পিছনের উঠানে কিংবা বাড়ির নির্দিষ্ট কোনো স্থানে তাদের কোরবানির পশু জবাই করত। কিন্তু শহরায়নের ফলে বেশিরভাগ মানুষেরই এখন আর বাড়িতে এ রকম বাড়তি জায়গা নেই এবং তাদেরকে রাস্তায়ই পশু জবাই করতে হয়। ১৩৪ বর্গমাইলের ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস এবং বিশ্বের ষোড়শ ঘনবসতিপূর্ণ শহর এটি। গড়ে প্রতি বর্গমাইলের মধ্যে এক লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। ঘনবসতির কারণে সাধারণের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বাদ দিয়ে রাস্তার মধ্যেই পশু কোরবানি করা হয়। ঈদের দিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে শহর কর্তৃপক্ষ জবাই করা পশুর অবশিষ্টাংশ এবং রক্ত সরিয়ে নেয়। পরিচ্ছন্নতায় দেরি হলে গণমাধ্যম ও সাধারণের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় কর্তৃপক্ষকে।
ব্যাপক শহরায়নের ফলে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের বেশিরভাগ খাল অকেজো হয়ে গেছে। এ কারণে ঢাকাতে রয়েছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। এ কারণে বর্ষাকালে ঢাকার অনেক অংশে অনেক সময় ধরে প্লাবিত থাকে।
এবার ঈদুল আজহার দিন লোকজন যখন তাদের পশু কোরবানি করছিলেন তখন শহরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় ঢাকার কিছু কিছু জায়গায় জবাইকৃত পশুর রক্ত বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে রক্তের ‘নদী’র মতো দেখাচ্ছিল।
ঈদের দিন বিকেলে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে দেখা যায় রক্তবর্ণের পানিতে ভরে আছে একটি রাস্তা। স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমের অনলাইনে ছবিটি দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি একটি সংবাদ প্রচার করা হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার রক্ত নদী’। এরপর দুবাইয়ের খাকি টাইমসসহ আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমগুলোও সংবাদটি প্রচার করতে শুরু করে। এরপর বিবিসি, মিরর, সিএনএন, এবিসি নিউজ, নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজ, দ্য গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও সংবাদটি প্রচার করতে শুরু করে। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের অনলাইন এডিশনে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। ভারতীয় এবং পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোও তা প্রচার করতে শুরু করে। সকল সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত ছবি এবং ভিডিও ছিল ঢাকার শান্তিনগরের একটি এলাকার। কয়েক দশক ধরেই এ এলাকায় জলাবদ্ধতার ব্যাপক সমস্যা রয়েছে।
পশু কোরবানির কারণে ঢাকার একটি ক্ষুদ্র অংশে বৃষ্টির পানিতে রক্ত মেশার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি ‘রক্তের নদী’ শিরোনামে সংবাদ হওয়ার যোগ্য নয়। ট্যাবলয়েড থেকে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর সবাই ‘হিট সাংবাদিকতার’ জন্য এটিকে কাভার করেছেন। টোপ ফেলে পাঠককে ওয়েবসাইটে ঢুকানোর জন্য ‘রক্তের নদীর’ মতো শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে তারা।
ডিজিটাল এ যুগে অনলাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে আর তা হচ্ছে ‘হিট সাংবাদিকতা’। সাধারণ একটি সংবাদকে এমন শিরোনাম দেওয়া হয় যাতে পাঠক বিষয়টিতে আগ্রহী হয়ে লিঙ্কে ক্লিক করেন। এরপর মূল লেখায় প্রবেশ করে দেখা যায়, শিরোনামের সঙ্গে লেখার কোনো সামঞ্জস্য নেই।
সংবাদপত্রের যেহেতু আয় কমছে সেজন্য তারা অনলাইনে বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এ কারণে সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার চেয়েও সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সস্তা পাঠকপ্রিয়তা বা হিট।
এ কারণেই ঢাকাকে নিয়ে ‘নিম্নমানের’ সংবাদ শিরোনাম করা হয়েছে যা আসলে হওয়ার ছিল না। আর এ ‘হিট সাংবাদিকতার’ জন্য মর্যাদাহানি হয়েছে বাংলাদেশেরও।
লেখাটি হাফিংটনপোস্টে লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর রুমি আহমেদ।
সৌজন্যে : প্রিয়.কম