ডেস্ক রিপোর্ট»‘তনুর জন্মের পর থেকেই আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসায় থাকা শুরু করি। রমজানের ঈদের ছুটি প্রায়ই সেনানিবাসের বাসায় কাটানো হতো। আর কোরবানির ঈদটা তনুসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে করতাম। কারণ শ্বশুরের নামে কোরবানি দেওয়া হতো। কিন্তু এবার আর তনু নেই। তনুকে ছাড়াই দুই ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে (মুরাদনগর) এসে শ্বশুর বাড়িতে কোরবানি দিয়েছি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। কান্না আর তনুর স্মৃতি হাতড়িয়ে ঈদুল আজহার দিন কেটেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর পরিবারের।
তনুর মা বলেন, ‘২৪ আগস্ট তনুর বাবা স্ট্রোক করেছেন। তিনি এখনও খুব অসুস্থ। তার স্মরণশক্তি কমে গেছে। আর আমি তো শোকের সাগরে ভাসছি। আমার বুকের মানিককে হত্যা করে আমার সংসারটা ধ্বংস করে দিয়েছে ঘাতকেরা।’
বুধবার সকালে মোবাইল ফোনে তনুর মা-বাবার সঙ্গে কথা হয় পরিবর্তন ডটকমের।
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছর কোরবানির ঈদের দিন আমার মেয়ে তনু ঘরের সব রান্না-বান্না করতো। এবার তো তনু নেই। তাই তার কবরের পাশেই গ্রামের বাড়িতে ঈদের দিন কাটালাম। আর বড় ছেলে নাজমুল ঢাকা থেকে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে দাদার নামে কোরবানি দিতে। আমার মা মারা যাওয়ার পর তনুই ছিল আমার মা। তনুর স্মৃতিগুলো মনে পড়লে আমার বুকটা খাঁ খাঁ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে হারিয়ে আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি কাকে নিয়ে এ দুনিয়াতে বাঁচব? আমি জানি না, আল্লাহ জানে। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর ৬ মাস পূর্ণ হবে তনু হত্যার। সেদিন আমার গ্রামের বাড়িতে একটি মিলাদ দেব ছোট বাচ্চাদের নিয়ে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার তনুকে হত্যার ৫ মাস ২৪ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার রহস্য উদঘাটন বা ঘাতকদের শনাক্ত করতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। তনুর মামলাটি যে তদন্ত করছিলেন তাকে বাদ দিয়ে জালাল নামে নতুন এক তদন্ত কর্মকর্তা তনু হত্যা মামলার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছে। এ ছাড়া মামলার বর্তমান অবস্থা কী তার কাছ থেকে জানতে পারিনি।’
ইয়ার হোসেন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘দেশের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেখেছি, কিন্তু আমার তনুর বিচার হবে না কেন? এতোদিন হয়ে গেল সিআইডি কিছুই করছে না, শুধু একের পর এক বিচারের আশ্বাস দিচ্ছে সিআইডি।’
চলতি বছরের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের জঙ্গল থেকে তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে ময়নাতদন্ত শেষে মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত করা হয়। দুই দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থা পরিবর্তন শেষে ৩১ মার্চ মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।
গত ৪ এপ্রিলে তনুর প্রথম ও ১২ জুন দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দেওয়া তার মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারেনি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। প্রথম প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও দ্বিতীয় প্রতিবেদনে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ উল্লেখ করায় তনুর পরিবারসহ দেশজুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিচারের আশ্বাস দেওয়া হলেও তদন্ত সংস্থা সিআইডি এখনও মামলার রহস্যের জট খুলতে পারেনি। তবে সিআইডির শেষ ভরসা তনুর ডিএনএ প্রতিবেদন।
সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে তনুর ডিএনএ প্রতিবেদনে ৩ পুরুষের শুক্রানু পাওয়া গেলেও তা শনাক্ত করতে এখনও সন্দেহভাজনদের ডিএনএ সংগ্রহ করতে আদালতের অনুমতি নেওয়া হয়নি। এতে তনু হত্যার রহস্য উদঘাটন ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে তনুর পরিবার ও সচেতন মহলের আশঙ্কা।
সূত্র।। পরিবর্তন ডট কম