ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবাধ প্রবেশ

ডেস্ক রিপোর্ট»ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি রোগীরাও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) উৎপাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না।

হরহামেশা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সিসিইউ’র ভেতরে প্রবেশ করছেন। টানাটানি করছেন রোগীদের ফাইল ও চিকিৎসাপত্র। অনেক সময় দলবেঁধে সিসিইউ’তে প্রবেশ করতেও দেখা গেছে এসব প্রতিনিধিকে।

সিসিইউ হলো হাসপাতালের একটি স্পর্শকাতর স্থান। এতে আশঙ্কাজনক রোগীদের ভর্তি করে রাখা হয়। ভর্তি রোগীদের প্রতি চিকিৎসক ও সেবিকাদের থাকে সার্বক্ষণিক নজরদারি। প্রায়ই সিসিইউ’তে ভর্তি রোগীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়। অথচ সেই স্পর্শকাতর কক্ষেই যখন-তখন অবাধে প্রবেশ করছেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এতে আশঙ্কাজনক রোগীর জীবন পড়ে যাচ্ছে আরও ঝুঁকির মধ্যে।

হাসপাতালের সেবিকা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিভিন্ন উপায়ে ম্যানেজ করে তাদের সামনেই চলছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের এই উৎপাত। এর সবকিছুই জানেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা। কিন্তু প্রতিকারে নেওয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ঢামেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. আব্দুল ওয়াদুদ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের রোগীদের চিকিৎসাপত্র নিয়ে টানাটানি করার বিষয়টি আমিও জানি। সিসিইউ’তে ঢুকে রোগীর চিকিৎসাপত্র ঘাটাঘাটি করা খুবই বিরক্তিকর। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার অভিযোগও করেছি। অভিযোগের পর কিছুদিন ভালো থাকে, এরপর আবার যা তাই।’

তিনি বলেন, ‘বাইরের দেশে সিসিইউ’তে রোগী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যে কারণে রোগীর সঙ্গে সিসিইউ’তে স্বজনদেরও থাকতে দেওয়া হয়। আর স্বজনদের প্রবেশের সেই সুযোগ নিয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও সিসিইউতে প্রবেশ করেন। এসব প্রতিনিধি এমন সময় সিসিইউতে প্রবেশ করেন, যখন চিকিৎসকেরা উপস্থিত থাকেন না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একাধিক দিন সকাল থেকে রাত অবধি পরিদর্শন করে হাসপাতালের সিসিইউ ও পিসিসিইউ কক্ষের ভেতরে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে দেখা যায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের উপস্থিতি।

এর মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। আর বিকালের পর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা বিভিন্ন ডায়াগস্টিক সেন্টারের নাম লেখা প্যাড নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী রোগী কোনো প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করাতে গেলেই তাকে ঘিরে ধরেন এসব দালাল।

বিভিন্ন উপায়ে রোগীদের বুঝিয়ে ঢাকা মেডিকেলের বাইরের ডায়াগস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় চিকিৎসক ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকাদের বসার স্থান ব্যবহার করে পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত নিতেও দেখা গেছে।

আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অধিকাংশই আসেন পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে। সিসিইউ ও পিসিসিইউ কক্ষে প্রবেশ করে তারা ডাক্তারদের মতো সিরিয়াল ধরে একের পর এক রোগীর চিকিৎসাপত্র দেখতে থাকেন। অনেক সময় পিঠে ঝুলানো ব্যাগটি রেখে দেন সেবিকা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকাদের জিম্মায়।

সিসিইউ ও পিসিসিইউতে প্রতিনিয়ত রোগীদের চিকিৎসাপত্র ঘাটাঘাটি করেন এমন একজন বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেডের মেডিকেল প্রমোশন এক্সিকিউটিভ উজ্জ্বল কুমার পাল। সন্ধ্যার পর প্রতিদিন সিসিইউ অথবা পিসিসিইউতে বেক্সিমকোর এই প্রতিনিধি অবস্থান করেন।

তিনি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ডাক্তার কোন কোম্পানির ওষুধ লিখছেন তা দেখার জন্য বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে লোক পাঠানো হয়। কারণ প্রেসক্রিপশনে কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য রিপ্রেজেন্টেটিভদের মাধ্যমে ডাক্তারদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিদিন সকাল থেকেই এখানে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা কোথায় অবস্থান করছি তা বিভিন্নভাবে মনিটরিং করা হয়। এমনকি আমাদের মোবাইল ফোনও ট্র্যাকিং করা হয়। শুধু আমাদের কোম্পানি না, সব কোম্পানির প্রতিনিধিই এখানে আসেন এবং প্রেসক্রিপশন পরীক্ষা করেন।’

ল্যাব বাংলাদেশের পরিচয় দিয়ে ইমরান নামের একজনকে রোগীর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে দেখা যায়। তাকেও প্রতিদিন সিসিইউ ও পিসিসিইউতে দেখা যায়।

রোগীর শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেলে রক্তের যে পরীক্ষাগুলো হয় না, সে পরীক্ষাগুলো বাইরে থেকে করার জন্যই রক্ত সংগ্রহ করেন। এতে রোগীদের কষ্ট করে নিজে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হয় না।

রক্ত নেওয়ার সময় কেউ বাধা দেয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক, সেবিকা, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সবাই আমাকে চেনে। তাই কেউ বাধা দেয় না।’

এদিকে সিসিইউ’র পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেলের প্রতিটি বিভাগেই রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উৎপাত। এর মধ্যে বহির্বিভাগে এসব প্রতিনিধির আনাগোনা সবচেয়ে বেশি।

মধ্য বয়সী বাবাকে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসেন যাত্রাবাড়ীর আরিফুল ইসলাম। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে বাবাকে ডাক্তার দেখান। এরপর ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হতেই তাদের ঘিরে ধরেন কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি।

ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভদের টানাটানিতে বিরক্তি প্রকাশ করেন আরিফুল। তবে তার সেই বিরক্তি প্রকাশে কোনো প্রকার কর্ণপাত না করেই অনেকটা জোর করে চিকিৎসাপত্রটি দেখে নেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

এতেই শেষ হয়নি আরিফুলদের ভোগান্তি। চিকিৎসকের দেওয়া চিকিৎসপত্র অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের দুই তলায় যান প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য। এখানে এসে তার ভোগান্তি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রায় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ব্যর্থ হন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করাতে। পরীক্ষার টাকা জমা নেওয়ার সময় শেষ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়ে দেন পরের দিন আসতে।

এ সময় আরিফুলদের কাছে ছুটে আসেন গ্রিন ল্যাবের পরিচয় দিয়ে মো. আলম নামের একজন। ‘দেখি দেখি’ শব্দ উচ্চারণ করেই আরিফুলের হাত থকে ছিনিয়ে নেন চিকিৎসাপত্রটি (পরীক্ষার জন্য বহির্বিভাগ থেকে দেওয়া স্লিপ)।

এরপর আরিফুলদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘ভাই এত কষ্ট করে পরীক্ষা করার দরকার কি? আমাকে দায়িত্ব দেন রক্ত নিয়ে গিয়ে কম খরচে পরীক্ষা করে এনে দেব।’

এ সময় দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের পরিচয় দিয়ে মো. আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনাদের অফিস কোথায়? উত্তর আসে পাশেই। এরপর ভিজিটিং কার্ড চাওয়া হলে আলম পরিচয় দেওয়া ওই দালাল ‘ভাই কার্ড এখন নেই’ এমন মন্তব্য করেই দ্রুত চলে যান।

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রোগী রহিমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। আমি এখানে নাকি এই টেস্ট করতে পারব না। ওনারা পপুলার মেডিকেলে টেস্ট করতে বললেন। আমি পুপলারে যাওয়ার আগেই এক লোক এসে বলল, আপনারে কষ্ট কইরা পপুলারে যাইতে হইব না। আমি রক্ত নিয়া গিয়া টেস্ট কইরা রিপোর্ট দিয়া যামু । এখন বলেন আমরা কোন দ্যাশে আছি। এইডা কি কোন নিয়ম হইল।

বাংলা সিনেমার কাহিনির মতো মনে হলেও পাঠক এটি কোনো নাটক বা সিনেমার কাহিনি নয়। এটি দেশের স্বনামধন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাস্তব চিত্র। শুধু সিসিইউ’তে ভর্তি রোগীরা বা আরিফুল নন; প্রতিনিয়তই এ ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীরা।

।। দি রিপোর্ট

প্রকাশক সম্পাদক : জাহাঙ্গীর কবির লিটন
এলাহী মার্কেট , ২য় তলা, বড় মসজিদ গলি, ট্রাংক রোড,ফেনী।
jagofeni24@gmail.com
© 2016 allrights reserved to JagoFeni24.Com | Desing & Development BY PopularITLtd.Com, Server Manneged BY PopularServer.Com