প্রভাষ আমিন»আহারে বিএনপির জন্য মায়াই লাগছে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি আজ জামায়াতের খপ্পরে পড়ে খাবি খাচ্ছে। একদিকে সরকারের মামলা-হামলা, দমন-পীড়ন; অন্যদিকে সিদ্ধান্তহীনতা আর ভুল সিদ্ধান্তে দলটির আজ লেজেগোবরে অবস্থা। দলটির এই দুরবস্থার জন্য দায়ী জামায়াতের সঙ্গে তাদের কাঁঠালের আঠা মার্কা প্রেম। জামায়াতের সাথে জোট করা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই নানা মত আছে।
কয়েকদিন আগে বিএনপির শুভাকাঙ্খী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক বর্তমান অবস্থায় থাকবে না বলে মত দিয়েছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যে দারুণ আশাবাদের সৃষ্টি হয় সুধী মহলে। কিন্তু কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি আসে জামায়াতের পক্ষ থেকে। জামায়াতে ইসলামী জানিয়ে দেয়, এমাজউদ্দিন আহমদ ২০ দলীয় জোটের কেউ নন। এ পর্যন্ত না হয় মানা যায়। কিন্তু পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়ে দেন, এমাজউদ্দিনের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত। ব্যস, পরিস্কার হয়ে গেল, বিএনপি-জামায়াত জোট সুপার গ্লুতে আটকানো। বিএনপি ডুববে, তবু মচকাবে না। জামায়াতের ৩ শতাংশ ভোটের অঙ্কেই বুদ বিএনপি। কিন্তু জামায়াতের সাথে জোট বাধার ফলে নিজেদের কত শতাংশ ভোট হারাচ্ছে, সে হিসাব কি কখনো কষে দেখেছে বিএনপি?
গ্রামে একটা কথা আছে, সামনে দিয়ে সুঁই গেলে লাফ দিয়ে পড়ে, পেছন দিয়ে হাতি চলে গেলেও টের পায় না। জামায়াত আছে বলেই বেগম খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েও সাড়া পাননি। জামায়াত সাথে থাকলে ড. কামাল, বি চৌধুরী, অলি আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের কখনোই পাশে পাবেন না বেগম জিয়া। এখন বেগম জিয়াকেই সরল অঙ্কটা কষতে হবে; কাদের পাশে পেলে তিনি বেশি লাভবান হবেন। বিএনপি জামায়াতের পক্ষে মানে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদেরও পক্ষে। যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের ব্যাপারে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও বিএনপি যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিএনপির নবঘোষিত কমিটিতে দুই দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীর সন্তান ঠাঁই পেয়েছেন। অনেকে বলছেন, পিতার অপরাধে সন্তানকে অভিযুক্ত করা বা শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। অকাট্য যুক্তি। কিন্তু বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী আছে। সেখানে এই দুজনকে না নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না। আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলিমের ছেলে ফয়সাল আলিমের ছেলে যে বিএনপির মাঠে খুব পরিচিত ও ত্যাগী সৈনিক, তেমনও নয়। তাদের দুজনের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আসলে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তাদের দলীয় অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করল।
কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর বিএনপির যে জাম্বো কমিটি ঘোষণা করা হল, তাতে কোনো চমক নেই, আছে ক্ষোভ। কমিটি বড় না ছোট, তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। প্রশ্ন হল, এই কমিটি কি খাদে পড়া বিএনপিকে টেনে তুলতে পারবে? মুখে যাই হোক, আমি জানি, বিএনপির সব নেতাকর্মীরা অন্তরে এই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তরই লালন করেন। কমিটির ঘোষণার দিনেই পদত্যাগ করেছেন নতুন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান বিএনপির পরীক্ষিত সৈনিক আলহাজ মোসাদ্দেক আলী, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুল ইসলাম শামীম। স্থায়ী কমিটিতে জায়গা না পেয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বিএনপির দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সৈনিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। এমনকি সাংবাদিকদের সামনে তার চোখের জল ঝরেছে। স্থায়ী কমিটিতে জায়গা অক্ষুন্ন থাকলেও সিরিয়ালে পিছিয়ে পড়ায় মন খারাপ সাবেক সেনা প্রধান মাহবুবুর রহমানের। বিএনপির মত একটি বড় দলের কমিটি ঘোষণার পর কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষোভ-বিক্ষোভের পাশে উল্লাসটাই সামনে আসার কথা। সেটা দেখা যাচ্ছে না কোথাও। নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উল্লাস নেই। এমনকি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দেওয়ার স্বাভাবিক দলীয় রীতিও দেখা যায়নি।
দৃশ্যত এটা বেগম খালেদা জিয়ার নিজ হাতে করা কমিটি। তিনি ছাড়া আর কেউ কিছুই জানতেন না। বলা হয়, গুলশান অফিস থেকে পাঠানো প্যাকেট খুলে কমিটি পাঠ করেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে আড়ালে কমিটি নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। সবাই বলছেন, এটা রিজভি-শিমুল কমিটি। শীর্ষ থেকে বিএনপির মাঠ পর্যায়- সবারই ক্ষোভ বেগম খালেদা জিয়া গুলশান অফিসে একটি চক্রের হাতে বন্দী। দলের মাঠ-পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নেত্রীর দেখা পান না। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ডা. জাফরুল্লা চৌধুরীও বেগম খালেদা জিয়াকে ইতিহাসে ঠাঁই পেতে অবগুণ্ঠন থেকে বেরিয়ে শক্ত হাতে বিএনপির হাল ধরার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর অনেকেরই অনেক প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, কেউ আড়ালে। তবে বিএনপির সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন খান মোহন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিএনপির রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনায় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি উদ্ধৃত করছি ‘গুডবাই বিএনপি, গুডবাই। বিদায়। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সম্পর্কের ইতি টানছি আজ। একদিন জিয়াউর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলাম, আজ সে বিএনপিকে দেখছি দুর্বৃত্ত-দুরাচার, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, নীতিহীন, লুচ্চা-লাফাঙ্গাদের কবলে পতিত। আজ বিএনপিতে নীতিবান, দলের প্রতি অনুগত, সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মীদের ঠাঁই নেই। আজ চাঁদাদাতা আর চাঁদা গ্রহীতারা বিএনপি’র দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যেখানে কর্মের মূল্যায়ন নেই, নিষ্ঠার কদর নেই, সেখানে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন লোক থাকতে পারেনা। তাই আমার প্রিয় দলকে আজ বিদায় জানাচ্ছি। কেউ হয়তো অবাক হবেন, কেউ বা বলবেন পদ না পেয়ে চলে গেল। যার যা খুশি বলুন, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। অন্যায়ের সাথে আপোস করিনি, করবো না।’ এটা ঠিক, পদ না পাওয়াতেই তার এই ক্ষোভ। পদ পেয়ে গেলে হয়ত তিনি চুপ করেই থাকতেন। তবু দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত মহিউদ্দিন খান মোহনের স্ট্যাটাসে যে অভিযোগুলো তুলে এনেছেন, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
কমিটি ঘোষণার পর মহিউদ্দিন খান মোহন একাধিক টক শো’তে বিএনপির কথিত সেই চক্রের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন। সেই টক শো’র অভিজ্ঞতা নিয়ে ১১ আগস্ট আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। সেটিও উদ্ধৃত করছি ‘গত দেড় বছরে (ফেব্রুয়ারি ২০১৫-আগস্ট ২০১৬) আমি ৮০/৯০টি টক শো’তে অংশ নিয়েছি। ওইসব টক শো’তে আমি আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছি। আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে সাবধান করতেন। বলতেন অত কড়া কথা না বলতে। অনেকেই দুশ্চিন্তায় থাকতেন আমাকে নিয়ে। কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগের কেউ আমাকে কখনো হুমকি দেয়নি। পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা হলে মুচকি হেসে বলতেন- ভাই এভাবে আমাদেরকে তুলাধুনা করলেন বা ধোলাই দিলেন! আমি বলেছি- ওটাই আমার কাজ। তারা হাসতেন। কিন্ত বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর মাত্র তিনটি টক শো’তে দলের কয়েকজন চিহ্নিত অসৎ লোকের সমালোচনা করায় ফেসবুক, মোবাইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপির সৈনিক পরিচয়ে আমাকে যেভাবে আক্রমণ করে কথা বলা হয়েছে, আমি অবাক হয়েছি। তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীরা কি আওয়ামী লীগারদের চেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে গেল! আওয়ামী লীগ পরমতসহিষ্ণু দল নয় এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মীর একি আচরণ! তাহলে কি সেই মনীষী বাক্যই ঠিক- উচিৎ কথার ভাত নাই!’
৩৮ বছর বিএনপির সাথে পথচলা একজনের এই প্রতিক্রিয়ার পর বিএনপির নেতৃত্ব নিজের অবস্থান আরেকবার ভেবে দেখতে পারেন। সৌজন্যেঃ পরিবর্তন.কম।
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
probhash2000@gmail.com